ওডেসা, দুভিল কোট।

গোধূলী সন্ধ্যা। খানিকক্ষণ বাদেই অন্ধকার নেমে আসবে। আব্রাহামের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো অলিভার পামেলা। তার সামনে আরও দু’জন যুবতী দাঁড়িয়ে ছিলো। যতই প্রহরের পর প্রহর কাটছিলো, ততই পামেলার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো যেন। শেষ পর্যন্ত চারদিকে ঝাপসা হতে হতে প্রগাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে পামেলা যুবতী দু’জনকে আদেশ দিয়ে বললো,

– রুলার ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। জলদি ঈষদুষ্ণ পানি নিয়ে এসো।

যুবতী দু’জন কামরার বাইরে বেরিয়ে গেল। পামেলা উঠে দাড়াল। পা টিপে টিপে কোমর দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পাতলা ফিনফিনে শর্ট গাউনে তাকে আবেদনময়ী লাগছিল। এই দুর্গে এসেছে একমাস হলো। এর মাঝে দু’বার রুলারের কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি আব্রাহামের কামরায় কোথায় কোনো আয়না দেখেনি। বিষয়টা তাকে বেশ কয়েকবার ভাবুক করে তুলেছিল। মনে মনে ভেবেছিল,

– এতো সুন্দর মানুষটার কি কখনো আয়না দেখার প্রয়োজন হয়নি?

আজও সেই একই ভাবনায় পামেলা বিভোর হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলো রুলারকে বলে তার শোয়ার কামরায় একটা বৃহদাকৃতির আয়না লাগিয়ে নিবে। দাসী দু’জন ঈষদুষ্ণ পানি গোসলখানার বাথটাবে রেখে গেলো। পামেলা কামরাজুড়ে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করে। সেদিনের ঘটনায় ফিরে যায়।

যেদিন আব্রাহাম স্যাভেরিন ডেনিস্টার নদীর বুকে জলদস্যুদের জাহাজ থেকে অলিভার পামেলাকে উদ্ধার করেছিলো। সাথে তার বন্ধুরা আর কয়েকজন দেহরক্ষী ছিলো। জাহাজে সংঘটিত হট্টগোল আর মা’রা’মা’রির মাঝে পামেলা হঠাৎ অচেতন হয়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন রুলারের বাহুবন্ধনে নিজেকে আবিষ্কার করে সে। প্রথমে ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলেও আব্রাহাম তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

– ভয় পেয়ো না। এখানের কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। জলদস্যুদের হ’ত্যা করে নদীতে ফেলা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, আমরা তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দিবো।

ক্ষনকালের জন্য দু’চোখে আশার আলো দেখতে পায় পামেলা। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মন বিষন্ন হয়ে গেল। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে করুন কন্ঠে বলেছিল,

– আমার আপন বলতে কেউ নেই। মা-বাবা, ভাই সবাইকে মে’রে ফেলেছে জলদস্যুরা। শুধু আমাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। আমার নিজের ঠিকানা বলতে কিছু নেই।

– ওরা তোমার সাথে কোনো খারাপ আচরন করেছে?

আব্রাহামের করা প্রশ্নে পামেলা বিদ্রুপের হাসি হাসে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,

– বাজারে কুমারী মেয়েদের অনেক দাম। তাই হয়তো তারা আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি।

– তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারি।

– কোথায়? _______পামেলা অকপটে জানতে চায়।

– ওডেসায়, আমার দুর্গে। ওখানে তোমার মতো আরও অনেক মেয়ে আছে।

পামেলার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ে। মনে মনে ক্রুর হাসে সে। তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। রুলার আব্রাহাম স্যাভেরিন তাকে ওডেসায় নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসে। কিন্তু পামেলা কখনো ভাবেনি এভাবে সে রুলারের প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাবে।

পামেলার ভাবনার মাঝখানেই কামরার দ্বারপ্রান্তে আব্রাহাম চলে আসে। পরিধেয় সবুজ রঙের স্যূট’টাকে এক আঙ্গুলের সাহায্যে কাঁধে ঝুলিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে কামরায় প্রবেশ করে। চোখের সামনে পামেলাকে দেখে তার ভ্রু কুঁচকে যায়। মেয়েটা তাকে সহাস্যে নত মস্তকে সম্মান জানিয়ে বলে,

– এস্টীম রুলার।

– তুমি এখানে?____বিস্মিত কন্ঠে আব্রাহাম জিজ্ঞেস করে।

– আমার মন বলছিলো, আপনি আজ দুর্গে ফিরে আসবেন। তাই আপনার গোসলের ব্যবস্থা করেছি।

– ওহ।

ভাবলেশহীন ভাবে শব্দটা উচ্চারণ করে স্যুট’টা বিছানার উপর রেখে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল আব্রাহাম। পামেলা মুচকি হেঁসে গোসলখানায় প্রবেশ করে। বাথটাবের ঈষদুষ্ণ পানিতে লেবু, হলুদ, মধু, দুধ এবং সুগন্ধি মিশিয়ে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দেয়। তোয়ালে গুছিয়ে রাখে। গ্লাসসমেত ওয়াইনের বোতল সাজিয়ে রাখে।

অকস্মাৎ উদোম গায়ে গোসলখানায় আব্রাহাম প্রবেশ করে। তার ফর্সা বুকের দিকে চোখ পড়তেই পামেলার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দু’পা এগুতেই হঠাৎ’ই পা পিছলে পড়ে যেতে নেয় সে। তাৎক্ষণিক তাকে ধরে ফেলে আব্রাহাম। মৃদুস্বরে ডাকে,

– অলিভার!

– আপনার নেশালো কন্ঠে যখন নিজের নাম শুনতে পাই, আমার এই জীবন ধন্য মনে হয়। শরীরের প্রতিটা শিরায় শিরায় প্রেমের উন্মাদনা ছড়িয়ে যায়।

কথাটুকু বলে পামেলা নিজের একটা হাত রাখে আব্রাহামের গালে।

– আহ! ______ আব্রাহাম কিঞ্চিৎ ব্যথাসূচক শব্দ করে উঠে।

– কি হয়েছে রুলার?

আব্রাহামের মনে পড়ে যায় সেই সাংঘাতিক মেয়েটার কথা। যার হাতের শক্তপোক্ত এক ঘুষিতে সে ব্যথা পেয়েছে গালে। মুহূর্তেই আব্রাহামের দু’চোখের সামনে মেয়েটার কান্নারত চেহারা ভেসে উঠে। সে কঠিন কন্ঠে পামেলাকে বলে,

– কিছু না। আজ আমার মুড নেই। তুমি এখন আসতে পারো।

– আপনার মন ভালো করে দেওয়ার সুযোগ দিন আমায়।___পামেলা কাতর কন্ঠে বলে।

– প্রয়োজন নেই।

আব্রাহাম এভাবে বলায় পামেলার মন বিষন্ন হয়। প্রহরের পর প্রহর গুনছিলো সে। শুধুমাত্র রুলারের সাথে একটু সময় কাটাবে বলে। কিন্তু রুলার তাকে ফিরিয়ে দিলো গুরুতর অবহেলায়। মন যেন মানতে চায়না। অশ্রুসিক্ত চোখে তবুও সে কামরা থেকে বেরিয়ে যায়।

_________★★_________

নিম্ন বিস্তারী নিবিড় রাত্রি। চারদিকে ঘোর অমানিশা। আচম্বিতে অস্বাভাবিক বাতাস বইতে শুরু করে। গাছপালাগুলো সব দুমড়ে মুচড়ে যায়। একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলে কাস্ত্রোরুজ থর্পের দিকে। সাথে সাথে থর্পের সীমানার কাছে একঝাঁক বাদুড় উড়ে যায়। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীটা মানুষের অবয়ব ধারণ করে। বিশালাকৃতির দু’টো কালো কুচকুচে ডানা মেলে শূন্যে ভেসে থাকে। বাদুড়গুলো তার আদেশ পেয়ে সীমানা পেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ওগুলোর গায়ে অকস্মাৎ আগুন লেগে যায়। ওদের দেহগুলো পুড়ে ছাই হয়ে পাহাড়ের খাঁদে হারিয়ে যায়।

অবয়বটা বেশ বিস্ময়াভিভূত হয়। যে আর কেউ নয়, স্বয়ং ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন। সে দ্রুতবেগে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। থর্পের সীমানা ঘেঁষতেই তার বিশালাকৃতির ডানা দু’টোতে আগুন লেগে যায়। পুনরায় সে ধোঁয়ার কুন্ডলীর রুপ নেয়। কাস্ত্রোরুজ থর্পের সীমানার বাইরে এক সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাড়ায়। মনে মনে সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়। তার এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়া জলন্ত অগ্নিবিন্দুর ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠে। যেখানে স্পষ্ট হিংস্রতা প্রকাশ পায়। সে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

– শক্তি দিয়ে সম্ভব না হলে বুদ্ধি খাটাতে হয়।

এদুয়ার্দো একটা প্রকান্ড পাথরের উপর বসে। পরিধেয় আকাশী রঙের শার্ট’টার হাতা ফোল্ড করে। সাদা প্যান্ট গুটিয়ে টাখনুর অনেকটা উপরে তুলে। মৃদুমন্দ বাতাসে তার মাথার ঘন কালো মসৃন চুলগুলো কপালে এসে পড়ে। কাস্ত্রোরুজ থর্পের দিকে তাকিয়ে ক্ষণকাল কিছু একটা ভাবে। অদূরে একটা পাহাড়ের গুহায় আগুন জ্বলতে দেখে। হয়তো কোনো মানুষ আছে সেখানে। এদুয়ার্দো নিজের দু’চোখ বুজে নেয়। অতঃপর ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। মনে মনে বলে,

– প্রত্যেকটা সমস্যারই অন্তত একটা সমাধান অবশ্যই থাকে।

হঠাৎই এদুয়ার্দোর তার মায়ের কথা মনে পড়ে। তার মা বলেছিলেন,

– কাস্ত্রোরুজ থর্পে অদৃশ্য ব্যারিয়ার দেওয়া থাকে। তুমি সেখানে স্বইচ্ছেয় প্রবেশ করতে পারবে না। যদি না সেই গ্রাম থেকে কেউ একজন তোমাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যায় সেখানে। ধরো, তুমি কারো সাহায্য নিয়ে কাস্ত্রোরুজ থর্পে প্রবেশ করলে, কিন্তু তোমার উপস্থিতি উইজার্ড ডিয়েটস ঠিক টের পেয়ে যাবে। কারন তার কাছে একটা অলৌকিক পাথর আছে, যার দ্বারা সে তোমাকে সহজেই খুঁজে নিবে।

– বুঝেছি। কিন্তু উইজার্ড ডিয়েটস’কে আপনার কি প্রয়োজন মা?____কৌতুহলী কন্ঠে এদুয়ার্দো জানতে চেয়েছিলো।

পিদর্কা স্যাভেরিন মুহূর্তেই থমকে গিয়েছিলেন। তার চোখ দু’টো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। গলা ধরে এসেছিল। কম্পিত কন্ঠস্বরে বলেছিলেন,

– উইজার্ড ডিয়েটস তোমাদের বাবার হ’ত্যা’কা’রী। তার জন্যই তোমরা ভাই-বোনেরা সবাই পিতৃহীন হয়েছ।

কথাগুলো এদুয়ার্দোর কানে কানে বাজল। সহসা তার ভাবনার অবসান হলো। ভয়াবহ রক্তচক্ষু মেলে তাকাল। আক্রোশের অনলে তার শিরা-উপশিরাগুলো যেন জ্বলতে শুরু করল। সে দৃঢ়কন্ঠে প্রতিজ্ঞা করে বলল,

– ডিয়েটসের অতি যত্নে রক্ষা করা এই কাস্ত্রোরুজ থর্প মৃতুপুরীতে পরিণত করবো। সাথে ওর পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে নির্মম মৃ’ত্যু উপহার দিবো।

এদুয়ার্দো স্থির বসে রইল। ভোর রাত পর্যন্ত সে গ্রামে প্রবেশ করার বিকল্প উপায় খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিল।

________★★________

রাত এগারোটা। রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে সবাই শুয়ে পড়েছে তখন। শুধু খাবার খায়নি সিয়া। সারাদিনে এক ঢোক পানিও পান করেনি। ইলহামা অ্যালিয়েভ কয়েকবার ডেকে গেছেন, কিন্তু কামরার দরজা খুলেনি। কেঁদে কেটে একেবারে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে ও।

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সিয়া আজই প্রথম কাঁদছে। কত বড় বড় শাস্তি হজম করেও মেয়েটা শক্ত থেকেছিলো। অথচ আজ ওর চোখ থেকে অবাধ নোনা জলের ফোয়ারা গড়িয়ে যাচ্ছিল। রাত এগারোটা বেজে গেছে অথচ এখনো বাড়ি ফিরেননি ওর বাবা। মনে পড়তেই সিয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। ওর মন সীমাহিন অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করল।

পাহাড়, মাঠ, খেত, নদীর পাড় সব জায়গায় নিজের বাবাকে খুঁজে দেখেছিলো। সারাদিন অপেক্ষা করেছিলো। কিন্তু ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একবারও বাড়িতে ফিরে আসেনি ক্রিসক্রিংগল। সিয়া বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। হঠাৎই ওর একটা গুহার কথা মনে পড়ে গেল। যেখানে প্রায়ই ওর বাবা যোগ-বিয়ামের জন্য যেতেন। কিন্তু সেটাতো গ্রামের সীমানার বাইরে অন্য একটি পাহাড়ে ছিল। সিয়া মনে মনে ঠিক করে নিল সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আগে সেখানে খুঁজতে যাবে।

বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে দু’চোখ বুঁজে নিলো। ঘন্টা খানিক সময় গড়িয়ে গেল। কিন্তু ওর চোখের পাতায় বিন্দুমাত্র ঘুম নেমে এলো না। মন কেমন অস্থির হয়ে উঠল। শুয়ে থেকে এপাশ অপাশ করল। অতঃপর পুনরায় উঠে বসল। কিচ তখনো জেগে ছিল। খাঁচার মধ্যে বসে থেকে কুটুর কুটুর করে কাঠ বাদাম খাচ্ছিল। সিয়া ওর দিকে তাকাল। ম্লান কন্ঠে বলল,

– আমি জানি রাতের বেলা বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। যেকোন বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু বাবাকে না দেখে আমি শান্তি পাচ্ছি না। তুমি কি আমার সাথে যাবে?

কিচ খাঁচার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। সিয়া আস্তে করে দরজা খুলে দেয়। কিচকে সাথে নিয়ে কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটে। আবারও চারপাশে দেখে। সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলায় নেমে যায়। দেয়ালের সাথে ঝুলিয়ে রাখা লন্ঠন’টা হাতে তুলে নেয়। তারপর কিচকে কোলে নিয়ে চোরের মতো বাড়ির সীমানা পেরিয়ে যায়।

বাড়ির প্রতিটা সদস্য নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছেন। কারন তারা জানেন ক্রিসক্রিংগল কোথায় আছেন। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবেছিলেন নিজের বাবাকে খুঁজে পেতে সিয়া ঠিক কি কি করতে পারে?

_________★★________

ঘুটঘুটে অন্ধকার। গা হিম হয়ে আসা প্রকৃতির জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটতে সিয়ার বেগ পেতে হয়। থেকে থেকে ঝোপঝাড় নড়ে চড়ে উঠছিল। সিয়া ভয় পেল না একটুও। দুঃসাহস যোগাল মনে। এক মাইল রাস্তা অতিক্রম করার পর লোকালয় শেষ হয়। শুরু হয় গহীন বন-জঙ্গল। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে লন্ঠনের মৃদু আলোয় সিয়া কখনো কর্দমাক্ত, কখনো বা পিচ্ছিল পথ ধরে হাঁটে। যেখানে নিজের ছায়াটুকুও দেখা যায়না, সেখানে অদৃশ্য কিছু ছায়ার অস্তিত্ব অনুভব করে। সিয়া একহাতে লন্ঠনটা শক্ত করে ধরে, অন্যহাতে কিচকে আঁকড়ে ধরে। বাইবেলের কয়েক লাইন শব্দ উচ্চারণ করে। মনের জোর বাড়ে। বনবাদাড় পেরিয়ে আরও এক মাইল হাঁটে।

রাত কয়টা বেজে গেছে কে জানে! ঝোপঝাড়ের পাশ থেকে ঝিঁঝিঁ আর চেনা-অচেনা বিভিন্ন পোঁকার ডাক ভেসে আসে। কখনো বা শুকনো পাতার উপর পা পড়তেই তা মরমর করে বাজে। ধুকপুক করে উঠে সিয়ার হৃদপিণ্ড। একহাতের সাহায্যে কিচ আর লন্ঠন একসাথে ধরে। কতবার ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। হাঁটতে হাঁটতেই ওর মনে হয় ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছে। একেতো পিচ্ছিল রাস্তা তারউপর পেরুতে হয় লম্বা সাঁকো। এক বাঁশ নিচে, আরেক বাঁশ ধরে হাঁটার জন্য উপরে সোজাসুজি বেঁধে রাখা ছিলো। এক বাঁশের সাঁকো’টা পেরিয়ে যেতে সিয়ার পা ফসকে যাচ্ছিলো। পড়তে পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর আরও সাবধানে পা ফেলে হেঁটে সাঁকো পেরিয়ে গেল।

পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে গেছে পাথুরে ঝিরি। এই ঝিরিপথ পেরিয়ে গুহায় যেতে হবে। ঝিরিপথে এবরো থেবরো পাথর বিছানো ছিল। ভুল জায়গায় পা পড়লে একদম খাঁদে গড়িয়ে পড়ে যাবে। সিয়া সেই ঝিরিপথ ধরে হেঁটে কাস্ত্রোরুজ থর্পের সীমানা পেরিয়ে গেল। সামনে যতদুর চোখ যায় সুউচ্চ সব পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে সিঁড়ির মতো করে বানানো হয়েছিলো। সিয়া একটা পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। কয়েক বছর আগেও এই গুহায় পৌঁছাতে হলে দড়ি বা পাহাড়ের লতা ধরে উঠতে হতো। কিন্তু ক্রিসক্রিংগলের উদ্যোগে গ্রামের মানুষজন মিলে সিঁড়ি তৈরি করেছিল। পাহাড়ের মাঝখানে লম্বাকৃতির গুহাটি প্রায় একশো বিশ ফুট লম্বা এবং সাত-আট ফুট চওড়া ছিলো। গুহার মুখ পর্যন্ত এসে সিয়া বেশ কিছুটা ভড়কে গেল। ভেতরটা নিকষ কালো অন্ধকার। তার বাবা থাকলে দু’একটা মশাল জ্বলতো নিশ্চয়ই?

লন্ঠন হাতে কিচকে সাথে নিয়ে সিয়া গুহার ভিতরে প্রবেশ করল। আচমকা একটা বাদুড় এসে ওর পিলে চমকে দিল। সিয়া হঠাৎ’ই ভীষণ ভয় পেল। এমনিতেই সারাদিন না খেয়ে থেকে শরীর দূর্বল হয়ে গিয়েছিল। গুহার ভেতরে কেউ নেই বুঝতে পেরে উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু কোত্থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে এসে ওকে আক্রমণ করে বসল। অকস্মাৎ আক্রমণে কোল থেকে কিচ পড়ে গেল। সিয়া দু’হাতের আঘাতে বাদুড়গুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে দৌড়াতে শুরু করল। সহসা গুহার অভিমুখে এসে হোঁটচ খেয়ে নিচে পড়ে গেল। গিরিখাতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু কেউ একজন ওর এক হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নিল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।