আমজাদ সিকদারের পুরো শরীর কাঁ*পছে ক্রো*ধে। চোখের কোটর টগ*বগে। ক্ষুব্ধ বদন সিকদার বাড়িতে সু*নামি বসাতে যথেষ্ট। বাড়ির প্রতিটি সদস্য থমকে রয়েছে। উৎকন্ঠা তাদের আঁদোলে। কারো মুখে কথা নেই,চোখ ভাষাহীন। শুধু ক*ম্পিত হাত পা, আর ভ*য়ার্ত দুই লোঁচন নিবদ্ধ সিড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দুটো মানুষের ওপর।
রুবায়দা ছুটে গিয়ে পিউকে আগলে ধরলেন। মিনমিন করে বললেন,
‘ ওকে মা*রলেন কেন ভাইজান,ওর তো কোনও দো*ষ নেই।’
মিনা বেগমের চোখ ছলছলে। অথচ রে*গেমেগে বললেন,
‘ যায় কেন বড়দের মধ্যে কথা বলতে? কতবার মানা করেছি পাঁকামো করবিনা,ছোট ছোটর মতো থাক।’
পিউ নাক টানল। ঠোঁট উলটে মিশে গেল রুবায়দার বুকের সাথে। তিনি আদর করলেন,গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালেন,
‘ বেশি ব্য*থা লেগেছে?’
পিউ ওপর নীচে মাথা ঝাঁকাল। লেগেছে মানে,মনে হচ্ছে গালের ওপর মরিচ ঢেলে দিয়েছে কেউ। কী একটা গাল,তাও সবার এত পছন্দ? যে পারে ঠা*স ঠা*স করে মে*রে দেয়!
আনিস ফিরেছেন কেবল। বাড়িতে ঢুকেই মুখোমুখি হলেন গুরুগম্ভীর পরিবেশের। কেমন নিস্তব্ধ,নির্জীব সবকিছু। যে সিকদার বাড়ি প্রতিটা মুহুর্ত হাসি,উল্লাস,গল্পে মশগুল রয়, তার থমথমে রূপ চিন্তায় ফেললো ওনাকে।
আস্তে-ধীরে, নিঃশব্দে স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ছোট রিক্তর মাথাটা গুঁজে রাখা মায়ের কাঁধের মধ্যে। চোখের পল্লব ক*ম্পিত। ক্ষুদ্রাকৃতির মুখবিবর শুষ্ক। সুমনা ওকে নিয়ে ওপরেও যেতে পারছেন না। সিড়িঘরেই যে দাঁড়িয়ে ওনারা। আনিস স্ত্রীর পাশে এসে,কানের কাছে গিয়ে শুধালেন,
‘ ব্যাপার কী?’
হঠাৎ শব্দে চকিতে তাকালেন তিনি। স্বামীকে দেখে ফিসফিস করে বললেন,
‘ কখন এলে?’
‘ এইত।’
সুমনা চোখ বড় বড় করে বললেন,
‘ ভ*য়াবহ কান্ড ঘটেছে।’
‘ কী হলো আবার? ধূসর কিছু…’
‘ কথা বোলোনা। নিজেই বুঝতে পারবে।’
আনিস বাধ্যের ন্যায় মেনে নিলেন। ব্যগ্রতা প্রকাশ না করে চুপ রইলেন। মনোযোগ নিক্ষে*প করলেন ধূসরদের দিকে। ছেলেটার ভাবলেশহীন,উদ্বেগশূন্য ভাবমূর্তি তাকে সর্বদা মুগ্ধ করে। ভ*য়ডরহীন এক শ*ক্ত মানব। তাদের বাড়িতে এত সাহস কারোর নেই। যাকে কোনও হু*মকি,ধা*মকি কাবু করতে পারে না। যখন ভাইজান ওকে কথা শোনান,তার খা*রাপ লাগে। পক্ষ নিয়ে কিছু বলতেও পারেন না। ভাইদের চক্ষুশূ*ল হওয়া তার কাছে পাপের সমান যে। তাইত উপায়শূন্য হয়ে চুপ থাকেন।
কিন্তু আজ আবার কী করল ছেলেটা? মারা*মারি করেছে কী? তার চোখ প্রকট হলো ভাবতেই। পুরো দস্তুর একাগ্রতায় ঘরের সবাইকে একবার একবার দেখলেন। পিউয়ের দিক চোখ পড়তেই কপালে ভাঁজ পরল। মেয়েটা ওমন ফুপিয়ে কাঁ*দছে কেন? কেউ মে*রেছে? কে মার*ল?
আনিস ঠোঁট দুটো স্ত্রীর কানের কাছে এগোলেন ফের।
‘ পিউ কাঁ*দছে কেন?’
সুমনা জানালেন ‘ ভাইজান মে*রেছেন।’
আনিস আকাশ ভে*ঙে মাটিতে পরলেন। এই জীবনে ভাইজান কে সবাইকে ব*কতে দেখলেও পিউকে একটা টোকাও দিতে দেখেননি। পিউয়ের মুখের সাথে মায়ের মিল থাকায় দূর্বল ছিলেন তিনি। মেয়েটা দুষ্টুমি করলেও সহ্য করতেন। বলতেন,ওতো আমার মা,মাকে বকা*ঝকা করা যায়?
‘ বড় আব্বু,মাথা ঠান্ডা করুন। গ*রম মাথায় কোনও কিছু…’
পথিমধ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন আমজাদ।
‘ চুপ করো। তোমার লেকচার শুনতে চাইনা আমি।’
উচ্চ ধ্বনিতে আরো একবার বসার ঘর কাঁ*পে। পিউ ভ*য়ে রুবায়দাকে শ*ক্ত করে আগলে ধরল। তার পা টলছে,গাল জ্ব*লছে। সাথে মন আর বুক ব্য*থায় একশেষ।
আনিস প্রবল বিস্মিত,বিহ্বল। ধূসর যত যাই করুক,আজ অবধি ভাইজান এত রে*গে কথা বলেননি তো। ঘটনা কী খুবই সাং*ঘাতিক?
অথচ এই চেঁচামেচি,ধ*মক,ধূসরের শরীর ঘেঁষে চলে গেল। তার চোখ-মুখের লেশমাত্র পরিবর্তন হয়নি। ততোধিক ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আপনাকে লেকচার দিচ্ছিনা আমি। ভুল ভাবছেন।’
‘ কীসের ভুল? তুমি তোমার বন্ধুর হয়ে ওকালতি করতে চাইছোনা ধূসর? চাইছো না আমার ব্রেইন ওয়াশ করতে?’
ধূসর স্পষ্ট জানাল,
‘ না। আমি চাইছি আপনাকে বোঝাতে। পুষ্প যদি ইকবাল কে চায় এতে দো*ষের কী আছে? ভালোবাসা তো অ*ন্যায় নয়।’
আনিসের ভ্রু কুঞ্চন হাওয়া। প্রকান্ড ধা*ক্কা খেলেন। বিদ্যুৎ বেগে ইকবাল,পুষ্পকে দেখলেন। চোখ ফিরিয়ে স্ত্রীর দিক ফিরতেই মুখোমুখি হলেন সুমনার সহায়হীন দৃষ্টির। এই তাহলে কাহিনী? আনিসের বুঝতে বাকী থাকল না। ঝ*ড়ের পূর্বাভাস ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পেয়ে গেলেন। দুপাশে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন,
‘ ভাইজান এই সম্পর্ক কোনও দিন মানবেন না। ধূসরের চেষ্টা জলে যাবে।’
‘ ভালোবাসা অন্যায় আমি বলিনি। কিন্তু এর মতো একটা অস*ভ্য ছেলেকে ভালোবাসা একশবার অন্যায়।’
ইকবালের দিক আঙুল তাক করলেন আমজাদ। লজ্জায় ছেলেটা মাটিতে মিশে গেল। এক জীবনে এতটা অপমা*নিত হয়নি সে, যতটা সামান্য কয়েক ঘন্টায় করেছেন তিনি। হোক,আরো না হয় হবে। তার মান সম্মান সব ধূলোয় মিশে যাক আজ। এসবের বিনিময়ে হলেও পুষ্পকে যেন পায়৷ মেয়েটাকে জীবনে পেলেই তৃপ্ত সে। আর কিচ্ছু চাইবেনা, কিচ্ছুনা।
ধূসরের ভ্রুঁ নেমে এলো চোখের কাছে। সোজাসাপটা প্রশ্ন ছু*ড়ল,
‘ ওকে অস*ভ্য কীসের ভিত্তিতে বলছেন আপনি? ও নেশা করে? জুয়া খেলে? না কী রাতের বেলা মেয়েবাজি করে বেড়ায়?’
লাগামহীন কথাবার্তায় নারীরা চোখ নামিয়ে নিলেন। আমজাদ হতবাক, হতচেতন। পরমুহুর্তেই হেসে ফেললেন।
‘ তোমার তো দারূন অধপতন হচ্ছে দেখছি। বড়দের সাথে এইভাবে কথা বলতেও মুখে বাঁধছেনা?’
কণ্ঠে বিদ্রুপ। ধূসর বলল,
‘ বাঁধছে না কে বলল? কিন্তু উপায় যে নেই বড় আব্বু। সবার জানা উচিত,আপনার ইকবালকে কেন এত অপছন্দ? কী ক্ষ*তি করেছে ও আপনার? ‘
‘ ক্ষ*তি? ওই এক আঙুল ছেলে আমার কী ক্ষ*তি করবে? ও যা সর্ব*নাশ করেছে সেতো তোমার করেছে। ইনফ্যাক্ট এখনও করছে। তোমার এই চমৎকার উন্নতির পেছনে দ্বায়ী একমাত্র এই ছেলেটা। বিপথে নিতে উস্কেছে তোমাকে। বেপ*রোয়া বানিয়েছে। বেয়া*দব তৈরি করেছে। ‘
ধূসর ফোস করে শ্বাস ফেলল। এই এক কথা শুনতে শুনতে বিদ্বিষ্ট সে। ঘাড় ডলল অধৈর্য ভাবে।
যেন কঠি*ন প্রয়াসে শান্ত করছে নিজেকে।
তারপর আবার তাকাল আমজাদের দিকে। স্থির গলায় বলল,
‘ আমি কচি খোকা নই বড় আব্বু। মাটির পুতুলেরও নই যে ইকবাল যা মন চাইল, তাই বানাবে। আমি যা হয়েছি আমার ইচ্ছায়। ওয়ান কাইন্ড অব, আপনাদের ক*ড়া শাস*নের বিরুপ প্রভাব এটা৷ আর ইকবালকের ওপর দো*ষ চাপাচ্ছেন কেন? ছোট থেকে আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা তদারকিতে রেখেছেন। রাজনীতির ভূত নামাতে বিদেশে অবধি পাঠিয়েছেন। তাও শুধরাতে পারলেন না মানে সেটাত আপনাদের ব্যর্থতা। এত বছরেও যা পারেননি, ও দিনের চার পাঁচ ঘন্টা সাথে থেকেই সেসব করে ফেলল? শুনতে হাস্যকর লাগছেনা? ‘
আমজাদ কটমট করে বললেন,
‘ ভাষণ অন্য কোথাও দাও ধূসর। এটা পার্টি অফিস নয়। কেউ তোমার ভাষণ শুনতে আসিনি আমরা। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।’
তর্জন শুনেও নড়ল না ধূসর। বিন্দুমাত্র হেলদোলও দেখালো না। বলল,
‘ ভাষণে কেউ খা*রাপ কিছু কখনও বলেনা। আপনার যদি আমার কথাগুলো ভাষণ মনে হয়,তাহলে নিঃসন্দেহে আমি ভালো কিছু বলছি।’
আমজাদ দাঁত চে*পে বললেন ‘ তুমি সরবে ধূসর? আমার মেয়ে আর আমার মাঝে বাইরের কেউ ঢুকুক আমি চাই না।’
শীতল অপ*মান গায়ে মাখল না ধূসর। যেন শোনেইনি সে। বলল,
‘ ইকবাল আমার বন্ধু,পুষ্প আমার বোন। ওদের ব্যাপারে আমি কথা বলার অধিকার নিয়েই জন্মেছি। আপনি বাইরের কেউ বললেই তো বাইরের হচ্ছিনা।’
আমজাদ ক্ষে*পে গেলেন। ধূসরকে ক*ষে একটা থা*প্পড় মারার অভিপ্রায় জাগল। নিজের ছেলে হলে এতক্ষণে মে*রেও বসতেন। রা*গে ফোসফোস করলেন শুধু। ধূসর নম্র কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি ওদের সম্পর্কটা মেনে নিন বড় আব্বু। ইকবাল খা*রাপ ছেলে নয়। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি,পুষ্প সুখি হবে।’
ইকবাল আপ্লুত চোখে চেয়ে রইল। আরো প্রবল অনুতাপ ঘিরে ধরল বক্ষগহ্বরের আশপাশ।
আমজাদ কঠোর স্বরে বললেন,
‘ তোমার গ্যারান্টি আমি চাইনি। তুমি নিজেই তো মানুষ চেনোনা। এরকম একটা ফাজিল ছেলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ঘুরে বেড়াও। তোমার বুদ্ধি আমি নেব ভেবেছো?
পুষ্পর বিয়ে হলে সাদিফের সঙ্গেই হবে। এন্ড ইটস ফাইনাল।’
সাদিফ চ সূচক শব্দ করল। চাচার বেশি বোঝার ধরণে সে বীতস্পৃহ। পুষ্প ভাইয়ের পেছন থেকে ভ*য়ে ভ*য়ে বলল,
‘ আমি ইকবাল কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না আব্বু।’
আমজাদ আ*গুন চোখে ফিরলেন। পুষ্প আত*ঙ্কে ধূসরের পিঠের সাথে শেঁটে গেল। তিনি গ*র্জে উঠলেন,
‘ কক্ষনও না। দরকার পরলে তোমাকে কে*টে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব আমি। তবু ওই ছেলের সাথে বিয়ে দেব না,দেব না, দেব না।’
ইকবাল অসহায় কণ্ঠে শুধাল
‘ কেন আঙ্কেল? আমার অপরা*ধ কী? আমি জীবন দিয়ে হলেও সচেষ্ট থাকব পুষ্পকে ভালো রাখতে। ‘
‘ তুমি চুপ করো। আমাদের মধ্যে কথা বলবেনা একদম। লজ্জ্বা করেনা তোমার,এত কিছুর পরেও এখানে দাঁড়িয়ে আছো।’
ধূসর ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আপনাকে ভালোভাবে বুঝিয়েছি ,অথচ আপনি বুঝতেই চাইছেন না। মেয়ের সুখটা আপনার কাছে বড় নয়? বড় আপনার পছন্দটা?’
‘ আমার মেয়ের সুখ কোথায় সেসব তোমার থেকে আমি ভালো জানব।’
‘ জেনেও অন্যায় করতে চাইছেন কেন তবে? আপনি তো এরকম নন। আমার বাবা মায়ের সময়ে তাদের পাশে আপনি ছিলেন৷ অথচ আজ?
ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসলে মেনে নিতে দো*ষ কীসের? আপনি যেটা করছেন সেটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’
আমজাদ দুই ভ্রুঁ উঁচুতে তুলে বললেন,
‘ এখন আমাকে তোমার থেকে ঠিক ভুল শিখতে হবে? তুমি আমায় বোঝাবে আমি কী করব?’
‘ যার যেটা ভালো,তার থেকে সেটা শেখা দো*ষের কিছু নয়। ‘
আমজাদ আঙুল উঠিয়ে বললেন,
‘ চুপপ। একদম চুপ। আরেকটা কথা বললে….’
ধূসর ভ্রুঁ নাঁচায়,
‘ হাত তুলবেন? তুলুন। আমার অসুবিধে নেই। একটা কেন,একশটা চ*ড় মা*রার অধিকার আপনার রয়েছে। কিন্তু এমনি এমনিতো চ*ড়, থা*প্পড় আমি খাব না। আমার গায়ে হাত তুলতে হলে, পুষ্পর হাতও ইকবালকে দিতে হবে। আফটার অল রাজনীতি আর ব্যবসা একসাথে সামলাচ্ছি,বিনিময় ছাড়া চলা যায়?’
সুমনা এতক্ষণ গুরুত*র ভঙিতে দেখছিলেন সব। ধূসরের মাত্র বলা কথাটায় হাসি পেল তার। সে হাসি কোনও ভাবেই আটকে রাখা গেল না। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মোছার ভাণ করে ঠোঁট চে*পে ধরলেন।
আমজাদ নাক-মুখ কূঁচকে বললেন,
‘ কীসের সাথে কী মেলাচ্ছো তুমি? মাথা ঠিক আছে? বলেছি না,পুষ্পর সাথে সাদিফের বিয়ে হবে? আমার ভাই যখন চেয়েছে আমার মেয়েকে, দুনিয়া উলটে গেলেও এই বিয়ে আমি দেব।’
আজমল মুখ খুললেন এবার। একটু এগিয়ে এসে ভদ্রভাবে বললেন,
‘ ভাইজান! আমার মনে হয় আপনি আরেকটু ভেবে দেখুন। আসলে পুষ্প আমাদেরও মেয়ে। ও কাউকে ভালোবাসে আমাদের তো বলেইনি। বললে কোনও দিন এরকম প্রস্তাব আমরা দিতাম না। এখন জেনেই যখন গিয়েছি তখন আর…… ‘
আমজাদ খ্যাক করে উঠলেন
‘ বোকার মত কথা বোলোনা আজমল! পুষ্প ছোট! ভালো মন্দ বোঝার বয়স ওর হয়েছে? কে ভালো কে খারাপ,এই বয়সে ও বুঝবে কী করে?’
ধূসর তিঁতিবিরক্ত হয়ে চোখ বুজে ফের খুলল। মিনা আমতা-আমতা করে বললেন,
‘ আপনি শান্ত হন। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। ইকবাল তো ভালো ছেলে। ওকে আমরা ছোট বেলা থেকে জানি,চিনি। বাড়িটাও কাছে। আমার মেয়ে যদি ওকে নিয়ে ভালো থাকতে চায়,তবে আমরা কেন আটকাব? সংসার তো আর আমরা করব না।’
আমজাদ স্ত্রীর বিরোধিতা মেনে নিতে পারেলেন না। কাট*কাট জবাব দিলেন,
‘তোমার মতামত এখানে কেউ জানতে চেয়েছে? চুপ করে ছিলে,চুপ করে থাকো। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে যেন না দেখি।’
ভদ্রমহিলার মুখটা চুপসে গেল। গাল বেকিয়ে বিড়বিড় করলেন
‘ সব জান্তা সমশের এসছেন। নিজে বোঝে যেন।’
আমজাদ সরাসরি ধূসরের চোখের দিক চেয়ে বললেন,
‘ একটা কথা শুনে রাখো,তুমি বা তোমার বন্ধু যত চেষ্টাই করো,যত অনুরোধই করো না কেন,আমজাদ সিকদারের কথার নড়চড় হবে না। মেয়েকে আজীবন ঘরে বসিয়ে রাখব,তবুও ইকবালকে আমি জামাই বলে মেনে নেব না। ‘
ধূসর বুকের সঙ্গে হাত ভাঁজ করে বলল,
‘ এটাই আপনার শেষ কথা?’
তিনি অনতিবলম্বে বললেন ‘ হ্যাঁ। ‘
পুষ্প ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠল। আমজাদ মেয়ের দিক তাকালেন ও না। গটগট করে রওনা করলেন ঘরের দিকে। সিড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতেই ধূসর বলল,
‘ আমার কথাটাও তাহলে আপনার শোনা উচিত। ‘
আমজাদ থামলেন। ফিরে তাকালেন না। ধূসর ঘুরে চেয়ে বলল,
‘ ইকবাল আর পুষ্পকে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেব আমি। নিজে হব সেই বিয়ের সাক্ষী। এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।’
প্রত্যেকের চোখ বেরিয়ে এলো প্রায়। স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে।
ইকবাল- পুষ্প হতভম্ব হয়ে একে অপরকে দেখল। ওরা তো এরকম কিছু মাথাতেও আনেনি কখনও।
আমজাদ তড়িৎ বেগে ঘুরে চাইলেন। পুরু কণ্ঠে শুধালেন,
‘ কী বললে?’
‘ যা শুনলেন। পুষ্প সাবালিকা,ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওর ওপর কিছু চা*পিয়ে দেয়ার অধিকার আপনার নেই। এটা ২০২৩, এই যুগে বাবা মায়ের জোরা-জুরিতে অন্য কাউকে বিয়ে করার ট্রেন্ড উঠে গিয়েছে। প্রসঙ্গ যদি হয় সেখানে আমার মত ভাইয়ের,তবে নিঃসন্দেহে আমি তা হতেও দেব না। ইকবাল- পুষ্পর বিয়ে হবে,হবেই। আপনি না চাইলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব ওদের। তারপর যখন এলাকায় এলাকায় রটে যাবে, আমজাদ সিকদারের মেয়ে,পালিয়ে বিয়ে করেছে,আপনার মান সম্মান থাকবে তো? ওরাতো সংসার করবে,আপনার কী হবে বড় আব্বু?’
ধূসরের নির্ভীক,সুস্পষ্ট জবাব।
আমজাদ থরথর করে উঠলেন উষ্মায়,
‘ তুমি কি আমাকে ভ*য় দেখাচ্ছো?’
ধূসরের সাবলীল উত্তর,
‘ সিকদার ধূসর মাহতাব ভ*য় নয়,কাজে করে দেখায়। ‘
আফতাব সিকদার চুপ থাকতে পারলেন না আর। ছেলেকে ধ*মক দিলেন,
‘ ধূসর, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। ভাইজানের বিরুদ্ধে যাবে এখন? বাড়ির মধ্যে অশা*ন্তি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ আজকাল। ‘
ধূসর বাবার দিক ফিরল। অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ তুমি এটাকে অশান্তি বলছো? বাবা তুমি? তুমি নিজেইতো একদিন এই পরিস্থিতি পেরিয়ে এসেছিলে। মায়ের বিয়ে অন্য কোথাও হয়ে যাওয়ার ভয়ে যখন নিজেই বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলে,তখন তো ভাবোনি যে বাড়িতে অশান্তি হবে। দাদুর সাথে বিরোধিতা হবে। ভেবেছিলে?’
আফতাব অপ্রস্তুত ভঙিতে কপাল কোঁচকালেন। ছেলেটা দূর্বলতায় ঘা মে*রেছে বলে পালটা, যুতসই জবাব পেলেন না।
ধূসর ভীষণ সহজ -সুলভ কণ্ঠে বলল,
‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়্যার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার বাবা। আমি বিশ্বাস করি,কেউ কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে, তাকে নিজের করে পাওয়ার সম্পূর্ন অধিকার তার আছে। ‘
বলার সময় তার চক্ষুদ্বয় ঘুরে এলো পিউয়ের মুখস্রী হতে। মেয়েটা গাল ব্য*থা ভুলে গেল। কথাটা শুনেই রুবাকে ছেড়ে, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। তার মুগ্ধ, বিমোহিত নেত্রযূগল ধূসরের শ্যামলা চেহারায়। ধূসর ভাই ভালোবাসার এতকিছু বোঝেন? তবে প্রকাশ করেন না কেন?
তার আওড়ানো এই দুটো লাইন কবিতার ন্যায় কানে বাজল পিউয়ের। তূখোড় ভাবে মস্তিষ্কে ঢুকল।
‘ ইকবাল যদি খা*রাপ হোতো,সবার আগে এই বিয়ের বিপক্ষে আমি যেতাম। কিন্তু আমি ওকে চিনি। ধূসর কারো হয়ে এমনি এমনি কথা বলে না। ‘
আমজাদ ক্রো*ধে গজগজ করে বললেন,
‘ দেখেছো তোমার ছেলেকে? চাচার পেছনে ছুড়ি মা*রার জন্য আদা-জল খেয়ে লেগেছে। দেখেছো কেমন অ*সভ্য তৈরি করেছ? বাপের অতীত নিয়েও খোঁচা দিচ্ছে এখন। ‘
রুবায়দা বিনয়ী কণ্ঠে বললেন,
‘ ভাইজান,ওতো ভুল বলেনি। এই পরিস্থিতিতে তো একদিন আমিও ছিলাম। এর মত বিষা*ক্ত,বিপ*র্যস্ত সময় একটা মেয়ের জন্য দ্বিতীয়টি হয়না। এই দেখুন,বাবার বিপক্ষে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম বলেই আজ আপনার ভাইকে পেয়েছি। সংসার করছি, সুখীও হয়েছি আল্লাহর রহমতে। বাবাও একটা সময় আমার সুখ দেখে মেনে নিয়েছিলেন আমাদের। অথচ সেদিন যদি ওনার জোরা-জোরিতে অন্য কাউকে বিয়ে করতাম,আপনার ভাই বা আমার দুজনের জীবনটাই ন*ষ্ট হোতো। বাবা তো বেচে নেই,কিন্তু আমার খুশিটা ম*রে যেত সারাজীবনের জন্য। ‘
জবা বললেন
‘ ভাইজান,আপনি রা*গ করবেন না। ওদের সম্পর্কটা মেনে নিন। আমারও মন বলছে পুষ্প সুখী হবে। ‘
সাদিফের জ্বিভ নিশপিশ করল কিছু বলতে৷ কিন্তু সাহসে কূলালো না।
মিনা আবার বললেন,
‘ বাড়ির সবাই রাজী, আপনি এরকম করছেন কেন বলবেন? সমস্যা কী আপনার? ”
আমজাদ ফের ধম*ক দিলেন,
‘ তুমি চুপ করো। মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে পারোনি? তুমি থাকতে মেয়ে দুবছর ধর প্রেম করে বেড়ায় কী করে? কেয়ারলেস মহিলা কোথাকার।’
মিনা বেগম অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
‘ এভাবে বলছেন কেন? আমি কি সবসময় ওদের পাহাড়া দেব?’
আমজাদ তে*ড়েমেড়ে হা করলেন যোগ্য জবাব দিতে। ধূসর আটকে দিয়ে বলল,
‘ বড় মাকে ধম*কে লাভ নেই। যা হয়েছে তা পাল্টে যাবে না।’
‘ তোমার থেকে কিছু শুনতে চাইনা আমি। তুমি ভেবোনা আমাকে এসব ফা*লতু,লেইম হুম*কি দিয়ে ভ*য় দেখাবে। আমি আমার মেয়েকে চিনি,তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেনা পুষ্প।’
শেষ কথাটা পুষ্পর উদ্দেশ্যে বললেন তিনি। সে কা*ন্না থামিয়ে সজাগ চোখে চাইল। একবার ইকবালকে দেখে বাবাকে দেখল। একজনের কাতর দুটো চোখ,অন্যজনের আস্থা। দুজন মানুষের কারো মনই ভে*ঙে দেয়ার সাধ্য ওর নেই। সিদ্ধান্তহী*নতায় ভীষণ রকম ভুগল সে। কী বলবে জানেনা! চোখের জলের মাত্রা জোড়াল হয়। কা*ন্না কেমন উগলে আসে। একটু সাহারা পেতে, নিভু চোখে ধূসরের দিক তাকাল সে। ওমনি ধূসর কিছু একটা ইশারা করল। পিউয়ের ভ্রু বেঁকে গেল তাতে। সে স্পষ্ট দেখেছে ধূসরের ইশারা। কিন্তু কী বোঝালেন উনি?
পুষ্প ঢোক গি*লল। মিহি,মৃদূ কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ইকবাল ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে চাইনা আব্বু।’
ইকবালের বক্ষ থেকে বিশাল, বড় পাথর নেমে গেল। আমজাদ সিকদার বাকরুদ্ধ । মেয়ের এই কথাই তাকে বুঝিয়ে দিলো উত্তর। একটা কথাও আর বললেন না। গটগট করে চলে গেলেন কক্ষে। পুষ্প অসহায় নেত্রে দেখল বাবার প্রস্থান।
ধূসর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়াল। অগাধ প্রণিধানে কিছু ভাবল। পরপর পা বাড়াল কামড়ায়। যেতে যেতে একবার চোখ বোলাল পিউয়ের গালে। দৃষ্টিতে ঠিকড়ে পরল প্রবল মায়ার স্রোত। চ*ড়টা যেন ওর গালে লাগেনি,লেগেছে তার কলিজায়।
ইকবাল ধূসরের যাওয়ার দিক চেয়ে থাকে। তারপর নিজেও হন্তদন্ত হয়ে ছোটে ওর পেছনে। ধূসরের কাছে করা বিরাট অন্যা*য়ের ক্ষমা চাইবে সে। প্রয়োজন পরলে পা ধরে ঝুলে পরবে। কিন্তু ক্ষমা না নিয়ে ছাড়বে না।
পিউ ভাবছে সে কী করবে? রুমে যাবে না কী যাবেনা? দোনামনা করতে করতে শেষমেষ রওনা করল। পুষ্প শ*ক্ত হয়ে মাথা নীচু করে আছে। এক্ষুনি মা ধম*কাবেন ওকে। মা*রতেও পারেন। অথচ মিনা কিছুই বললেন না। ব্যস্ত পায়ে হাঁটা ধরলেন ঘরের দিকে।
সাদিফ ক্লান্ত ভঙিতে সোফায় বসে পরল। বুক ভরে শ্বাস ফেলল। যাক! অবশেষে বিয়েটা ভা*ঙছে। এইবার আর পিউকে হারানোর চান্স নেই।
জবা পুষ্পর কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় হাত রাখতেই মেয়েটা নড়ে ওঠে। তিনি হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ বোকা মেয়ে,আমাকে জানালে কী হোতো? আমি কি তোর শত্রু রে? একবার বলে দেখতি আমাদের। এইরকম প্রস্তাব তো জীবনে রাখতাম না। তোর খুশিই তো আমাদের কাছে সবার আগে। ‘
পুষ্প ঝরঝর করে কেঁ*দে ফেলল। হুড়মুড় করে জড়িয়ে ধরল ওনাকে। জবা মাথায় চুঁমু খেয়ে বললেন,
‘ কাঁ*দিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে মা। দেখিস।’
****
আমজাদ কেদারায় দুলছেন৷ নরমাল চেয়ারটাকে রকিং চেয়ারের মত ইচ্ছে করে নাড়াচ্ছেন। ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। ঘরের এসি,ফ্যান দুটোই বন্ধ। ঘেমে গিয়েছেন। অথচ তার রা*গ পরছে না। ধূসর আর ইকবালের প্রতি ক্রো*ধে পেট ফাঁটছে তার। বাড়ির সবাইকে হাত করে নিয়েছে এই ছোকরা। কেউ তার কথা শুনছেনা। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে। সবাই বানর দুটোকে মাথায় নিয়ে নাঁচে। কী ভেবেছে,ওর ধম*কিতে সে ভ*য় পাবে? কোনওদিন না। পুষ্প যদি তার অমতে ওই ছেলেকে বিয়ে করেই বসে, সোজাসুজি ত্যা*জ্য করে দেবেন। একটিবারও পিছপা হবেন না এই সিদ্ধান্তে। চেনেনা তো তাকে। ওই ছেলে বুঁনো ওল হলে সেও বাঘা তেঁতুল।
তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই দরজা ঠেলে দেয়ার শব্দ হয়। মিনা ঘরে ঢুকেছেন। ওনাকে দেখেই নড়েচড়ে বসলেন আমজাদ। তৎক্ষনাৎ মুখটাকে ঘুরিয়ে ফেললেন আরেকদিকে। ধরেই নিলেন,তাকে মানাতে এসেছেন উনি। কিন্তু তিনিতো মানবেন না। না মানে না। আসুক এই মহিলা, একটা বার খুলুক মুখটাকে!
অথচ তার ধারণা মোতাবেক কিচ্ছুটি হলো না। মিনা বেগম টু শব্দ করলেন না। ফিরেও দেখলেন না তাকে। উলটে খাটের ওপাশে গিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পরলেন৷ আমজাদ সাড়াশব্দ না পেয়ে তাকালেন,এই দৃশ্যে হতভম্ব না হয়ে পারলেন না। কিছুক্ষণ বসে রইলেন চুপচাপ। যখন দেখলেন মিনা নিষ্পৃহ, পাত্তাই দিচ্ছেন না তাকে, বাধ্য হয়ে নিজেই উঠে গেলেন। গিয়ে বসলেন খাটের এ পাশে। মনোযোগ পেতে দুবার গলা খাকাড়ি দিলেন। তাও মিনা ঘুরলেন না। আমজাদ বিদ্বিষ্ট হলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ বলি হচ্ছেটা কী?’
মিনা চোখ বন্ধ রেখেই বললেন,
‘ আপনি ঘুমালে আলোটা নিভিয়ে দিন। চোখে লাগছে।’
প্রসঙ্গ আর পছন্দ মাফিক উত্তর না পেয়ে আমজাদ রে*গে গেলেন।
মিনাকে টেনে ঘুরিয়ে ফেললেন নিজের দিক। তিনি ভড়কে বললেন,
‘ কী হলো?’
‘ কী হলো মানে? বাড়িতে এত বড় একটা কান্ড ঘটার পরেও তুমি এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাইছো?’
‘ তো কী করব? ঝ*গড়া করব আপনার মত?’
‘ আমি ঝ*গড়া করি?’
‘ তো কী করেন? না বুঝে শুনে চেঁচামেচি করেন সবসময়। আর নিজেকে দাবী করেন বুদ্ধিমান হিসেবে। সবার মধ্যে আবার দোষা*রোপ করছেন আমাকে।’
আমজাদ চোখ কপালে উঠিয়ে বললেন,
‘ কী বলতে চাও? আমি বোকা? বুদ্ধি সব তোমার আর তোমার আদরের ছেলের ঘঁটে? যে সবার সামনে আমাদের এইভাবে ছোট করল!’
মিনা উঠে বসলেন এবার,
‘ ও আপনাকে ছোট করেনি। করবেও না। শুধু আপনার বিপক্ষে দুটো কথা বলেছে। যা বলেছে খারাপও বলেনি। আমি ওর জায়গায় থাকলেও একই কথা বলতাম।’
‘ কী? মাথা গেছে তোমার? কী আবোল-তাবোল বলছো! বাড়ির সবার সামনে পুষ্পকে ভাগিয়ে নেবে বলল এটা কী ভালো কথা ছিল?’
‘ ওটা ও এমনি বলেছে৷ আপনি মানছিলেন না তাই। ধূসর বাড়ির সম্মান ন*ষ্ট হোক,এরকম কিছু করবে বলে মনে হয় আপনার? ‘
‘ তাহলে বলল কেন? কেন বলবে? আমি ওর তালতো ভাই, যে ও মজা করবে আমার সাথে?’
‘ আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন৷ ও এই কথায় আপনাকে কী বুঝিয়েছে একবার চিন্তা করুন। রুবা আর আফতাব বাড়ি থেকে না মানায় পালিয়ে বিয়ে করেছিল। আপনিইতো বলেছিলেন, তখন আব্বাকে মানুষের অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। এখন সেই একই কাজ আপনার মেয়ে করবেনা তার কী নিশ্চয়তা? ও আপনাকে বারবার বোঝাচ্ছে,অনুরোধ করছে, বলছে সে ইকবাল কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা। এখন আপনি বেশি জোর করলে ও যে পালিয়ে যাবেনা গ্যারান্টি আছে? বলুন আছে?’
এ যাত্রায় আমজাদ সিকদার বিভ্রান্তিতে পরলেন। পরপর গাল ফুলিয়ে বললেন,
‘ কিন্ত ওই ছেলেকে আমার সহ্য হয়না। ”
মিনা বললেন
‘ আপনার সহ্য দিয়ে কী হবে? সংসার আপনি করবেন, না আমি? যে করবে সে যদি সুখে থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়? আচ্ছা ধরুন,আজ আপনি নিজের পছন্দের একটা ভালো ছেলে দেখে মেয়েটাকে বিয়ে দিলেন। মেয়েটা মেনেও নিলো। কিন্তু মন থেকে মানবে? কলের পুতুল বনে সংসার করবে না? জীবনভর দোষা*রোপ করবে আপনাকে। আজ বাদে কাল মা*রা যাব। শরীরটাও মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু মেয়ের মনে মনে, রা*গ, ক্ষো*ভ গুলো কি রয়ে যাবে না? কারো দীর্ঘশ্বাস,কারো ক*ষ্টের কারণ হলে ম*রেও তো সুখ পাব না। পারবেন মেয়ের চোখে আমৃ*ত্যু অপ*রাধি হয়ে থাকতে? ইচ্ছে আছে এমন?’
আমজাদ চুপ করে গেলেন। কথাগুলো মস্তিষ্কের দরজায় কড়া নাড়ল গিয়ে।
অনিশ্চিত কণ্ঠে বললেন
‘ কিন্তু ছেলে তো রাজনীতিবিদ! এটা কি ভালো কাজ?’
মিনা বেগম সুন্দর করে গুছিয়ে বললেন,
‘ দুনিয়ার সব খানেই ভালো- মন্দ আছে। পয়সার এপিঠ দেখলেই হবেনা, ওপিঠটাও দেখতে হবে৷ শুধুমাত্র রাজনীতিতেই যে মা*রামা*রি -কা*টাকা*টি হয় তাও না। শুনুন সব ভালো কাজ আপনার নিজের ওপর। আপনি যদি সৎ থাকেন,তাহলে যে কোনও কাজই আপনার জন্য স্বর্গ৷ নিজে ভালো হলে জগতটা ভালো হতে বাধ্য। ‘
( একটু থেমে)
ইকবাল কে ছেলেবেলা থেকে দেখেছি। বাজে আড্ডা,বা ওর নামে বাজে একটা কথা শুনিনি। বাবা কত বড় কলেজের প্রফেসর! ভদ্র -সভ্য পরিবার । বাড়িটাও হাতের নাগালে৷ মন চাইলেই মেয়েকে দেখে আসা যাবে। আর আজ যেভাবে সবার সামনে অস্থির হয়ে লাফিয়ে উঠছিল,আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পুষ্পকে আগলাল,আমি তাতেও মুগ্ধ হয়েছি। বোঝাই যায় মেয়েকে কত ভালোবাসে! এরপরেও অমত করবেন কোন স্বার্থে?’
আমজাদ সিকদার নিশ্চুপ,নিরুত্তর। মিনা মৃদু হেসে বললেন,
‘ আপনি ভালো করে ভাবুন। সময় তো আছেই। তবে আমার বিশ্বাস, আপনি ঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন। আজ অবধি আমার বিশ্বাস আপনি ভা*ঙেননি। এবারেও ভা*ঙবেন না ভরসা আছে।’
তিনি উঠে দাঁড়াতেই আমজাদ শুধালেন,
‘ কোথায় যাচ্ছো?’
‘ আপনার জন্য একটু শরবত করে আনি। ‘
‘ এখন?’
‘ হ্যাঁ। পছন্দের জিনিস খেতে খেতে ভাবলে,মাথা খোলে।’
তিনি হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন। সবটা কেমন গুলিয়ে ফেললেন আমজাদ। বিশাল রকম দ্বিধায় পরেছেন তিনি।
***
ধূসর থাই গ্লাসটা টেনে সরাল। ঘরের ভ্যাপসা গ*রম হুটোপুটি করে পালিয়ে গেল জানলা গলে। বারান্দার পাশে লাগোয়া আমগাছটায় গুঁটি ধরেছে সবে। দূর থেকে দেখলে একটা ঝাঁকড়া ফুল গাছের মতোন মনে হয়। চারপাশের শীতল বাতাস নতুন গুঁটির গন্ধে ম ম করে।
এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও মন ভালো করতে যথেষ্ট। আচমকা কেউ একজন পেছন থেকে জাপটে ধরল। ধূসর বিন্ধুমাত্র চমকায়নি। যেন জানত এরকমটাই হবে। বরং বারান্দায় যাওয়ার জন্য বাড়ানো পা টা আবার ফিরিয়ে এনেছে। ইকবাল গলা সা*পের ন্যায় পেচিয়ে ধরল দুহাতে। ভেজা স্বরে অনুরোধ করল,
‘ আমায় ক্ষমা করে দে ধূসর । আমি ভুল করেছি,অন্যায় করেছি। তুই আমায় যা ইচ্ছে শা*স্তি দে,কিন্তু আমায় ছেড়ে যাস না।’
ধূসর ঘাড় বাঁকা করে তাকাল। কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইল। ইকবাল হা-হুতাশ করে বলল,
‘ আমি ভ*য় পেয়েছিলাম। তুই যদি সব জানার পর আমাকে ভুল ভাবিস,দূরে সরিয়ে দিস,সেজন্য সাহস করে চেয়েও বলতে পারিনি।’
ধূসর হাত দুটো আলগোছে সরিয়ে দিলো। শরীর পুরো ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলো। সেকেন্ড খানিক একভাবে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল। পরপর আরেকদিক মুখ ঘোরায়। ইকবালের এই নিশ্চুপতা সহ্য হয়না। ধৈর্য হীন কণ্ঠে বলে ‘ কিছু বল ধূসর।’
সে ছোট করে বলল ‘ ভাবছি। ‘
‘ কী ভাবছিস?’
‘ সম্পর্কটা রাখব কী না!’
নিস্তব্ধ হয়ে পরল ইকবাল। আঁত*কে উঠল। অবিশ্বাস্য, ভ*য়ার্ত চোখে চেয়ে রইল। অচিরাৎ কেমন বাচ্চাদের মতন কেঁ*দে ফেলল সে। ধূসর বোকা বনে গেল কান্না দেখে। আবার হাসিও পেলো তার।
ইকবাল মায়া মায়া মুখ করে বলল,
‘ তুই আমায় মা*র, কা*ট,কিন্তু এসব বলিস না ধূসর। তোকে ছাড়া আমার চলবে না ভাই। ‘
ধূসরের উত্তর এলো না। তার পাথুরে চোখ-মুখ দেখে হতাশ হয় ইকবাল। মাথাটা নামাতেও পারেনা,আকষ্মিক ধূসরই জড়িয়ে ধরল ওকে। ইকবাল বিস্মিত, অবাক হলো। বড্ড অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল,
‘ তুই কি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিস ধূসর? ‘
সে মুচকি হেসে বলল,
‘ নির্বোধ! সামান্য কারণে ধূসর তার বেস্টফ্রেন্ড কে ছাড়বে, ভাবলি কী করে?’
ইকবালের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল খুশিতে।
পালটা আকড়ে ধরল এবার। শক্ত-পোক্ত বাধন দুজনের,একটা সময় মুক্ত হয়। ধূসর কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ পুষ্পর দায়িত্ব নিশ্চিন্তে তোকে দিচ্ছি ইকবাল। সন্মান রাখতে পারবিতো আমার বিশ্বাসের?’
ইকবালের দৃঢ় জবাব ‘ পারব।’
পরক্ষনেই চিন্তিত কণ্ঠে বলল,’ কিন্তু তোর চাচা?’
ধূসর এ যাত্রায় হাসল। দুদিকে সরে গেল অধর। বিড়বিড় করে বলল ‘ পিকচার আভিভি বাকি হ্যায়।’
*****
আমজাদ সিকদার পায়চারি করছেন। মহাবিরক্ত মুখভঙ্গি। মাঝে-মাঝে দেখছেন পার্কিং লটের দিকটায়। ইকবালের ধবধবে সাদা গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। তিনি চ সূচক শব্দ করলেন। এই ছেলে এখনও যাচ্ছেনা কেন? থেকে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে না কী!
তার হাঁটা-চলার মাঝে কক্ষের সামনে এলো কেউ। গুটিসুটি মেরে দরজা আগলে দাঁড়াল। উদ্বীগ্ন চোখে দেখল ঘরের ভেতর হাঁটতে থাকা আমজাদকে। কয়েকবার ঢোক গিল*ল। বুক ফুলিয়ে সাহস জমাল। আস্তে করে ডাকল,
‘ আব্বু।’
আমজাদ থেমে গেলেন। পেছন ঘুরে পুষ্পকে দেখেই মুহুর্তে শ*ক্ত করলেন চিবুক। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি? এখানে কেন এসেছো?’
পুষ্প বিনীত পায়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল। আকুল স্বরে বলতে গেল,
‘ আব্বু আমি….’
পথিমধ্যেই কথা কে*ড়ে নিলেন তিনি। থমথমে কণ্ঠে বললেন,
‘ আব্বু ডাকবে না। তোমার আব্বু হতে চাইনা আমি। যে বাবার কথাকে…. ‘
তার কথা সম্পূর্ন হয়না। আচমকা ছুটে গিয়ে পায়ের কাছে বসে পরল পুষ্প। আমজাদ থমকালেন। স্তব্ধ হলেন। সরে যেতে চাইলেন,পুষ্প রীতিমতো জড়িয়ে ধরল পা দুখানা।
হাউমাউ করে কেঁ*দে বলল,
‘ আব্বু আমি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তেমন ইকবালকেও ভালোবাসি। আমি, আমি তোমাদের দুজনকেই চাই আব্বু। একজনের বিনিময়ে অন্যজন কে আমি চাইনা। এর আগে আমি ম*রে যাব,নিজেই নিজের গলায় ছু*ড়ি বসাব।’
আমজাদের বুক কেঁ*পে উঠল৷ হোচ*ট খেলেন কথাগুলো শুনে। পুষ্প মুখচোরা,এভাবে কখনও কথা বলেনি। না এভাবে কাঁদতে দেখেছেন। প্রথম বয়সের প্রথম কন্যা, আবেগের এক অংশ । আমজাদের দৃঢ় মন নরম হলো। দুলে উঠল পিতৃত্ব।
মেয়ের কাঁধ ধরে দাঁড় করালেন। পুষ্প হেচকি তুলছে। আমজাদ নরম স্বরে শুধালেন,
‘ ভেবেচিন্তে চাইছো তো ইকবাল কে?’
পুষ্প মাথা নামিয়ে নেয়। নিরবতা ওনাকে বুঝিয়ে দেয় জবাব। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ এসো।’
তারপর ঘর ছাড়লেন। পুষ্প কিছুই বোঝেনি৷ দ্বিধাগ্রস্থ সে। কৌতুহল সমেত ছোট ছোট কদমে বাবার পিছু নেয়।
**
বসার ঘরে অল্প কয়কজনের উপস্থিতি। সোফায় বসে আছেন আজমল। পাশেই জবা। তাদের সামনে বসে আনিস আর সুমনা। সিরিয়াস আলোচনা চলছে। কেন্দ্রবিন্দু, বুঝিয়ে শুনিয়ে আমজাদকে মানানো।
একটু দূরে এ্যাকোরিয়ামের কাছে রিক্ত,রাদিফ খেলছে। আমজাদকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তারা। পেছনে পুষ্পর ভেজা, ভেজা চোখ- মুখ দেখেই একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। আমজাদ নেমে দাঁড়ালেন। রাদিফকে বললেন,
‘ যাওতো বাবা,সবাইকে ডেকে আনো।’
সে খেলা রেখে ছুটল। হুটোপুটি করে সবাইকে ডাকল। বাদ দিলো না পিউটাকেও। বড় চাচার হুকুম, সবাই মানে সবাই। আমজাদ যত শান্তভাবে বলেছিলেন,সে ততটাই অ*স্থির আর অশা*ন্ত হয়ে ডেকেছে। তাড়াহুড়ো পায়েই হাজির হলেন সকলে। মিনাও রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে শরবতের গ্লাস।
আফতাব চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কী ব্যাপার ভাইজান? কিছু হয়েছে?’
‘ সবাই আসুক, বলছি।’
ইকবাল আর ধূসর এলো সবার পরে। তারা আস্তে-ধীরে নেমে একপাশ হয়ে দাঁড়াল। আমজাদ সবাইকে একবার একবার দেখলেন। কৌতুহল সকলের চেহারায় স্পষ্ট।
তারপর সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন ইকবালের সামনে। ছেলেটা তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এই হিটলার শ্বশুরটাকে ওর বিশ্বাস নেই। চ*ড়- ট*ড় মেরে বসবেন না তো?
ধূসর পরল ঠিক ওদের মাঝামাঝি। সে ধা*রাল চোখে একবার আমজাদকে দেখে, বন্ধুর দিক তাকায়। আমজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভণিতা হীন শুধালেন,
‘ তোমাকে আমি পছন্দ করিনা, জানো নিশ্চয়ই? ‘
ইকবাল জবাব দিলো না। পুষ্পর বুক ধুকপুক করছে। পল্লব কাঁ*পছে। সবার জিজ্ঞাসু মুখভঙ্গি।
আমজাদ সেই মুহুর্তে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন,
‘ কাল শুক্রবার। তোমার বাবা-মাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলো।’
ইকবাল বেখেয়ালে মাথা নাড়ল। হুশ পেতেই চমকে তাকাল। পুষ্প হা করে ফেলল। আশ্চর্য সে নিজেও। অথচ ধূসর ফিচেল হাসে। দু আঙুল দিয়ে থুত্নী ঘষে জয়ের মুহুর্ত উপভোগ করে।
পিউ অপেক্ষা করে না। দুরন্ত পায়ে ছুটে এসেই বোনকে জড়িয়ে ধরল। পুষ্প পাথর বনে ছিল। চোখেমুখে অবিশ্বাস। পিউ ধরতেই সম্বিৎ ফিরল তার।
সবার মুখশ্রী অতুজ্জ্যল,ঝলমলে। স্বস্তির শ্বাস নেয় তারা। ইকবালের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটল। শ্রদ্ধায় লুটোপুটি খেয়ে, ভীষণ খুশিতে চট করে আমজাদের পা ছুঁয়ে সালাম করল সে। ভদ্রলোক এতেও বিরক্ত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
‘ অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।’