বাইজি কন্যা | পর্ব – ৭

-‘ তুমি কি জানো মোর প্রেয়সী আমার বাঁশি থামিয়ে দেওয়ার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে তোমার। ‘
-‘ ক্ষমতাটুকু না দিলেই হয়। ‘
-‘ মায়া,অনুভূতি, প্রেম এগুলোর জন্য কাউকে ঘটা করে ক্ষমতা দিতে হয় না মোর প্রেয়সী… আপনাআপনিই তৈরি হয়ে যায়। ‘
চোয়াল শক্ত করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মুনতাহা। ছাদের রেলিংয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুনতাহার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রঙ্গন। ওষ্ঠাধরে মিলছে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসি। কে জানে এই কিঞ্চিৎ হাসিটুকুর অর্থ কী? আশেপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে রঙ্গনের দিকে দৃঢ় চোখে চেয়ে মুনতাহা প্রশ্ন করলো,
-‘ নিশ্চয়ই তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে রঙ্গন। নিশ্চয়ই পেয়েছো সেই নারী’র দেখা, যে নারী ফিরিয়ে এনেছে তোমার বাঁশির সুর। ‘
-‘ উহুম আমার বাঁশির সুর ক্ষণস্থায়ী ছিলো না এটা দীর্ঘস্থায়ী, সুরের মাঝে শুধু প্রেম সাদ্ধের বাইরে চলে গিয়েছে। তবে নতুন প্রেমের সূচনা হয়ে গেছে বোধ হয়৷ ‘
-‘ প্রেমের আবার নতুন পুরানোও হয়? ‘
-‘ কেন নয়? আমরা যেমন বহুবার হাসি তেমন বহুবার কাঁদিও৷ আমাদের জীবনে যেমন বহুবার হাসি আসে,বহুবার কান্না আসে, ঠিক তেমনি বহুবার প্রেমও আসে। ‘
কিছু বললো না মুনতাহা বরাবরই রঙ্গনের কাছে হেরে এসেছে সে আজও জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-‘ কে সে? ‘
-‘ বলবো তার আগে তুমি বলো চোখের নিচের এই কালোদাগ কীসের প্রতীক স্বামী’র সোহাগের নাকি অবজ্ঞা’র? ‘
কথোপকথনের এ পর্যায়ে মুনতাহা’র পিছনে এসে দাঁড়ালো পলাশ চৌধুরী। অকস্মাৎ পলাশের উপস্থিতি’তে সংযত হয়ে দাঁড়ালো রঙ্গন। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে রক্তিম হতে লাগলো তার ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডল। করুণ দৃষ্টিতে একবার মুনতাহা আরেকবার পলাশের দিকে তাকালো। বললো,
-‘ মেজো ভাইয়া ভাবি বোধহয় শুকনো কাপড়গুলো তুলতে এসেছিলো। আমার সাথে দেখা হওয়াতে কেবলই দাঁড়িয়েছে। ‘
মুচকি হাসলো পলাশ। বললো,
-‘ আমি আমার অতিশয় স্নেহের ভাই’য়ের থেকে কোন জাবাব চাইনা। কেবল অতি আদরের সহধর্মিণী’কে নিজ কক্ষে দেখতে চাই। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো মুনতাহার। চোয়ালজোড়া কঠিন হতে শুরু করলো রঙ্গনের। এ মূহুর্তে তার ভাই’য়ের জায়গায় অন্য কোন পুরুষ থাকলে বিষয়টা তাণ্ডবে মোড় নিতো। কিন্তু ঠেঁকে গেছে এক জায়গাতেই মানুষ টা তার শ্রদ্ধেয় বড়ো ভাই। নিজ ভাই এবং ভাই’দের স্ত্রী’র প্রতি জমিদারের সকল পুত্রই অগাধ শ্রদ্ধাশীল। সেই সাথে ছোট ভাই’রা বড়ো ভাই’দের ওপর একটা কথাও বলার সাহস রাখে না। এদের মাঝে কেবল প্রণয় ভিন্নধর্মী স্বভাবের বলে এক গৃহে থাকাই তার জন্য কষ্টসাধ্য। না সে এ গৃহে থাকে আর না এসব অদ্ভুত বিষয় মেনে চলতে হয় তাকে৷ তার মধ্যে নীতি একটাই সঠিক সঠিক’ই। আর ভুল ভুল’ই। বড়োরা ভুল করবে বলে ছোটরা চুপচাপ থাকবে সঠিকটা বুঝাবে না এই নীতি সে মানতে পারে না। কখনো কখনো ছোটদের মতো বয়সে বড়োরাও ভুল করতে পারে এই জ্ঞান ধারণ করে ভুল পথে চালিত বড়ো’দের ছোটরাও সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে বা সঠিক জ্ঞান দিতে পারে এই ধর্মে সে প্রবল বিশ্বাসী। কিন্তু তার এ বিশ্বাস’কে জমিদার বাড়িতে মূল্যায়ন করা হয় না,ভবিষ্যৎে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাই যা সহ্য করতে সে অক্ষম প্রতিনিয়ত তা সহ্য করে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই গৃহ ত্যাগ করে পরিবার পরিজন ছেড়ে নিজ যোগ্যতায় দূরে থাকে সে। এতে জমিদার বাড়ির অপকর্ম থেকে যেমন দূরে থাকে তেমন ভাই’য়ে ভাই’য়ে দ্বন্দ, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ ঘটারও শঙ্কা থাকে না৷ কিন্তু সব মানুষ তো একই বৈশিষ্ট্যের হতে পারেনা৷ পারেনি রঙ্গনও। তাই তো নিজের ভালোবাসার মানুষ’টির থেকে প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছিলো সে৷ মেনে নিয়েছিলো সে প্রাণ প্রেয়সী’কে নিজের বড়ো ভাই’য়ের বউ রূপেও। এবং প্রতিনিয়ত মেনে নিতে হচ্ছে এক প্রিয়জন দ্বারা অপর প্রিয়জনের প্রতি হওয়া অন্যায় গুলো’কে। রঙ্গনের চক্ষের সম্মুখে মুনতাহার একটি হাত গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরে নিজ কক্ষে গেলো পলাশ৷ বদ্ধ ঘরে স্বামী-স্ত্রী’র অসংখ্যবার প্রেমময় উত্তাপ সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু পলাশ মুনতাহা দম্পতির বদ্ধঘরে সৃষ্টি হয় বিধ্বংসী লীলাখেলা। যেই লীলাখেলার হাহাকার থেকে বাঁচার প্রয়াসে ঘন অন্ধকারের নিস্তব্ধ অরণ্য’কেই বেছে নিয়েছে রঙ্গন। কিন্তু আজ নিরুপায় সে। যা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার’ই ভয়ংকর সাক্ষী হলো আজ! পলাশের কক্ষের পাশের সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়লো সে। ভিতর থেকে হঠাৎই থেমে গেলো মুনতাহার আর্তনাদ। শঙ্কিত হয়ে ওঠে দাঁড়ালো রঙ্গন৷ আশঙ্কা হলো অত্যাধিক শারীরিক অত্যাচারে জ্ঞান হারায়নি তো মুনতাহা? বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আশপাশে ঘুরতে শুরু করলো রঙ্গন।
এক পর্যায়ে নজর পড়লো পলাশের কক্ষের জানালা খোলা, পর্দাগুলোও মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। কোন দিক না তাকিয়ে কোন কথা না ভেবে কেবলমাত্র মুনতাহা ঠিক আছে কিনা এটুকু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছুটে দাঁড়ালো জানালার পাশে। দুরুদুরু বুকে শুধুমাত্র একনজর বিছানায় তাকালো। শুভ্র রঙের মোটা রশি দিয়ে বিছানার সঙ্গে চার হাত,পা বেঁধে মুনতাহার নগ্ন শরীরে তাণ্ডব করছে পলাশ৷ ওষ্ঠাধর ফাঁক করে মাঝবরাবর ওড়না জাতীয় একটি সূতি কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে রেখেছে যাতে ভিতরে শব্দ বাইরে না পৌঁছাতে পারে৷ কিন্তু কান্নার শব্দ গোঁ গোঁ স্বরে স্বল্প পরিমাণ ঠিক ধাক্কা খেলো রঙ্গনের কর্ণকুহরে,ধ্বংসাত্মক এক দৃশ্য দেখলো অসহনীয় চক্ষুদ্বয়ে। অভিঘানিত হয়ে সরে দাঁড়ালো রঙ্গন৷ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। রাগে,দুঃখে জর্জরিত হয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। বেখেয়ালি হয়ে পুরো দেহ কোন রকমে চালিত করে বেরিয়ে গেলো পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে। মুনতাহা ভাবে রঙ্গন’কে প্রত্যাখ্যান করার শাস্তিই সে পাচ্ছে। রঙ্গনের অভিশাপেই আজ তার জীবনের এই অধঃপতন। এ’কথা একদিন নিজ মুখেই রঙ্গন’কে জানিয়েছিলো মুনতাহা৷ সে কথা স্নরণ হতেই রঙ্গন আকাশপানে তাকালো। বিরবির করে বললো,
-‘ হে প্রভু তুমি তো জানো আমি কোন অভিশাপ দেইনি। তাহলে ঐ নিষ্পাপ মেয়েটা কোন শাস্তি ভোগ করছে কোন শাস্তি? ‘
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে পাঁচফোড়ন গৃহের সম্মুখে বাগানের মাঝবরাবর হাঁটু গেড়ে বসে শেষ বাক্যটুকু চিৎকার করে বললো রঙ্গন। পুরো পাঁচফোড়ন গৃহ’ই যেনো কেঁপে ওঠলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো কিছু হাহাকার,
-‘ এই ভালোবাসার জন্য তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করলে মুনতাহা এই ভালোবাসা? আমার জীবনে যাই ঘটুক তোমার এই ক্ষতটা আজীবন পুরাবে আমায়। তোমার ঐ দৃষ্টিতে আমি অভিযোগ ব্যতিত কিছুই খুঁজে পাইনা। আজকের পরও হয়তো অভিযোগ পাবো,ধ্বংসাত্নক এক অভিযোগ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কেবল একটাই অভিযোগ কেন ভালোবাসলে না আমায়? একটু ভালোবাসা, একটু অধিকারই তো চেয়েছিলাম, বিনিময়ে আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকতাম। বিশ্বাস করো একটুও ছলনা করছি না একটুও না৷ এই রঙ্গন পুরো পৃথিবীর সাথে ছলনা করতে পারে কিন্তু মুনতাহার সঙ্গে চুল পরিমাণ ছলনার কথা সে ভাবতেও পারে না। নিয়তির কাছে আমার একটাই অভিযোগ আমি কেন তোমার গোলাম হওয়ার সুযোগটুকু পেলাম না, কেন? ‘
আহত হৃদয়ে ওঠে দাঁড়ালো রঙ্গন। ভাঙাচোরা শরীরের ন্যায় চলতে শুরু করলো নিজ গন্তব্যস্থলে। অরণ্যের কুটীরে প্রবেশ করে ডিভানে গা এলিয়ে দিলো রঙ্গন৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখজোড়া বন্ধ করলো। দু’ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণা দিয়ে। মুখ দিয়ে অস্ফুটে স্বরে আওড়ালো,
-‘ আমি তোমায় অভিশাপ দেইনি মুন বিশ্বাস করো আমি তোমায় একটুও অভিশাপ দেইনি। ‘
[১৪]
ফজরের আজানের পরপরই বাইজি গৃহের মহিলা ভৃত্য রেশমা খাতুনের মেয়ে সখিনা শাহিনুর’কে ডেকে তুললো। বললো,
-‘ নুর এই নুর ওঠ ওঠ তাড়াতাড়ি ওঠ জমিদারের বাগান বাড়ি যাবি না? ‘
ঘুমকাতুরে কন্ঠে শাহিনুর বললো,
-‘ আরেকটু পর যাই সখী আরেকটু ঘুমাই। ‘
-‘ না না আর ঘুমানো যাবোনারে তাহলে আমরা ধরা পড়ে যাব তাড়াতাড়ি ওঠ নুর এখনি সময়। ‘
আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসলো শাহিনুর। দু’হাতে দু’চোখ কচলে বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সখিনার দিকে। বললো,
-‘ চল সখী চল আজ আমরা জমিদার বাড়ির ফুল চুরি করবো। জমিদারের ছেলে আমার মন চুরি করেছে আমার তো তার মন চুরি করার দুঃসাহস নাই। আমি বরং ফুল চুরি করেই মন’কে স্বান্ত্বনা দেই। ‘
এটুকু বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো শাহিনুর। সখিনা অপলক চেয়ে রইলো তার মুখপানে। শাহিনুরের স্নিগ্ধ মুখশ্রী,প্রাণখোলা নিষ্পাপ হাসি বরাবরই মুগ্ধ করে তাকে৷ সমবয়সী হওয়ার সুবাদে সখিনার সাথে শাহিনুরের বেশ সখ্যতা রয়েছে। শাহিনুর বাইজি কন্যা, সখিনা এক ভৃত্য কন্যা এতে বিন্দুমাত্র বিভেদ নেই তাদের মধ্যে। বরং গড়ে ওঠেছে অতুলনীয় বন্ধুত্ব। প্রায় সময়ই একসাথে কাটায় তারা। মাঝে মাঝে রাতেও এক সঙ্গে ঘুমায়। গতরাতেই দুই সখী মিলে পরিকল্পনা করেছে জমিদার বাড়ির বিশাল বাগান থেকে ফুল চুরি করবে তারা। দিনের আলোতে সেখানে যাওয়ার সাহস নেই। শারমিন তাকে যেতেও দেবেনা৷ তাই সবার অগোচরে দুই বান্ধবী মিলে চললো জমিদার বাড়ির বাগানের ফুল চুরি করতে….

লেখকের কথা: রিচেক দেইনি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। গল্পের স্বার্থে কিছু এডাল্ট শব্দ, বাক্য ব্যবহৃত হবে তবে অশ্লীলতা থেকে অবশ্যই দূরে থাকবো। আঠারো এইজের নীচে কারো কোন পাঠকের যদি পড়তে খারাপ লাগে তাহলে উপন্যাসটি এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ রইলো

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।